বাংলা ভাষার সমস্ত লেখক - এক জায়গায় ক্রমানুসারে
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্ম - ২৪শে জুলাই, ১৮৯৮ মৃত্যু - ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
লাভপুর, বীরভূম, ভারত কলকাতা, ভারত
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্ম - ২৪শে জুলাই, ১৮৯৮ মৃত্যু - ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
লাভপুর, বীরভূম, ভারত কলকাতা, ভারত
বাংলা কথাসাহিত্যে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব তিন "বন্দোপাধ্যায়" - এর মধ্যে অন্যতম হলেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় । বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন বলে তাকে বাংলার পাঠককূল "আধুনিককালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক" হিসাবে অভিহিত করে । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যোগ্যতম উত্তরসুরী হয়ে বাংলা সাহিত্যজগতে আবির্ভূত হন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় ।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় 1898 সালে জুলাই মাসের 24 তারিখে বর্তমান ভারতবর্ষের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের বীরভূম জেলার অন্তর্ভুক্ত লাভপুর গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে ভুমিষ্ঠ হন । এই সম্মাননীয় কথাসাহিত্যিকের পিতার নাম হরিদাস বন্দোপাধ্যায় এবং মাতার নাম প্রভাবতী দেবী । বাল্যবয়সে এই মহান কথাসাহিত্যিকের পিতৃবিয়োগ হলে তিনি মা ও বিধবা পিসির আদর-যত্নে প্রতিপালিত হন । এই শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক 1916 সালে লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে আই. এ. পাঠক্রমে প্রথমে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন এবং পরে সাউথ সুবার্বন কলেজে ( বর্তমানে আশুতোষ কলেজ) অধ্যয়ন করেন । কলেজে অধ্যয়নকালে এই মাননীয় কথাসাহিত্যিক গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন বলে তিনি ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা 1921 সালে তাকে এক বছরের জন্য নিজের গ্রামে অন্তরীণ হন । এর ফলে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবন এখানেই সমাপ্ত হয় । এই শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক জীবিকা নির্বাহ করার জন্য কিছুকাল কলকাতায় কয়লার ব্যবসা করেন এবং পরে তিনি চাকুরি লাভ করে কানপুরে গমন করেন ।
কানপুরে থাকাকালীন এই পূজনীয় কথাসাহিত্যিক কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে বাংলার সাহিত্য প্রাঙ্গনে প্রবেশ করেন । 1926 সালে এই বরণীয় কথাসাহিত্যিকের রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ " ত্রিপত্র " প্রকাশিত হলে কাব্যগ্রন্থটি পাঠকমহলে আলোড়ন তুলতে ব্যর্থ হয় । কাব্যগ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে এই স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক নিজের সাহিত্যজীবনের সূচনা করলেও কিছুদিন পরে তিনি "মারাঠা-তর্পণ" নামে একটি নাটক রচনা করেন । এই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকের রচিত "রসকলি" গল্প 1927 সালে "কল্লোল" পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সাহিত্য-সমালোচকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় । সেইসময় দেশজুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ হলে এই নির্ভীক কথাসাহিত্যিক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই আন্দোলনে যোগদান করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের আদেশে 1930 সালে এক বছরের জন্য কারারুদ্ধ হন। 1931 সালে কারামুক্ত হয়ে এই আদরণীয় কথাসাহিত্যিক নয় বছর গ্রামের বাড়িতে অতিবাহিত করে 1940 সালে কলকাতার বাগবাজারে বাড়ি ভাড়া করে সপরিবারে বসবাস আরম্ভ করেন এবং এক বছর এইখানে কাটিয়ে 1941 সালে এই শহরের অন্তর্ভুক্ত বরানগরে গমন করেন ।
এই প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক সাহিত্য রচনার মাধ্যমে দেশসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং নিজের পুরো সাহিত্যজীবনে বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে - পঞ্চাশটির বেশী উপন্যাস, দুশোর বেশী ছোটগল্প গ্রন্থ, বারোটি নাটক, চারটি আত্মজীবনী, চারটি প্রবন্ধ সংকলন , দুইটি ভ্রমণ কাহিনী , একটি প্রহসন, একটি কাব্যগ্রন্থ ও কিছু রচনা সংকলন । এই দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিকের রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -
উপন্যাস :- চৈতালি ঘুর্ণি (1931), পাষাণপুরী (1933), আগুন (1937), ধাত্রীদেবতা ( 1939), কালিন্দী (1940), গণদেবতা (1942), কবি (1942), পঞ্চগ্রাম (1943), হাঁসুলি বাঁকের উপকথা (1947), আরোগ্য নিকেতন (1953) প্রভৃতি;
ছোটগল্প গ্রন্থ :- ছলনাময়ী, জলসাঘর, রসকলি, বেদেনী, খাজাঞ্চিবাবু, ডাইনির বাঁশি, তাসের ঘর, অগ্রদানী, কালাপাহাড়, রাণুর বিবাহ প্রভৃতি;
নাটক :- মারাঠা-তর্পণ, দুই পুরুষ, দ্বীপান্তর, পথের ডাক, কালরাত্রি, সংঘাত প্রভৃতি;
কাব্যগ্রন্থ:- ত্রিপত্র;
প্রহসন :- চকমকি;
প্রবন্ধ সংকলন :- সাহিত্যের সত্য, ভারতবর্ষ ও চীন, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী প্রভৃতি;
আত্মজীবনী :- আমার কালের কথা, বিচিত্র স্মৃতিকাহিনী, আমার সাহিত্য জীবন ( প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), কৈশোর স্মৃতি;
ভ্রমন কাহিনী :- মস্কোতে কয়েক দিন;
রচনা সংকলন :- তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠ গল্প, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প , তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের প্রিয় গল্প, স্বনির্বাচিত গল্প, ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প, কিশোর সঞ্চয়ন, গল্প-পঞ্চাশৎ প্রভৃতি ।
এই মহামান্য কথাসাহিত্যিকের রচনাগুলিতে বেদে, সাঁওতাল, ডোম, জেলে থেকে আরম্ভ করে ব্রাহ্মণ পর্যন্ত সব শ্রেণী মানুষের জীবনযাত্রা, পরাধীন মানুষের মুক্তি সংগ্রাম , দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা ও দেশবিভাগের সুস্পষ্ট চিত্র সহজ ও সরল ভাষায় সুন্দরভাবে অঙ্কিত হয়েছে । তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের রচনাগুলি ভারতবর্ষ, প্রবাসী, দেশ, শনিবারের চিঠি, যুগান্তর, কালিকলম, কল্লোল, উপাসনা, বঙ্গশ্রী, বসুমতী, পরিচয় প্রভৃতি বিখ্যাত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতো । এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের একাধিক গল্প ও উপন্যাস নিয়ে ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে । এই আদর্শবান কথাসাহিত্যিক অর্থের প্রয়োজনে জীবনের শেষ প্রান্তে কিছুদিন দৈনিকপত্রে সাংবাদিকের কলম লিখেছেন এবং কিছু চিত্র অঙ্কন করেছেন ।
এই প্রতিভাধর কথাসাহিত্যিক নিজের অনন্য সাহিত্যকীর্তির জন্য শরৎ স্মৃতি পুরস্কার (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় , 1947), আরোগ্য নিকেতন উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ সরকার, 1955) ও সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার (1956), জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, 1956), গণদেবতা উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (1966) এবং ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী (1962) ও পদ্মভূষণ (1968) উপাধি লাভ করেন । এই কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক 1952 সালে বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং 1970 সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন । এই প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিক 1955 সালে ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে চীন এবং 1957 সালে তাসখন্দে এশীয় লেখক প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দিয়ে মস্কো সফর করেন । 1971 সালে সেপ্টেম্বর মাসের 14 তারিখে কলকাতাতে এই চিরস্মরণীয় কথাসাহিত্যিকের তিরোধান হয় । বিশিষ্ট সাহিত্য-গবেষক ভূদেব চৌধুরী তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে বলেছেন " বাংলা ছোটগল্গের মহাকবি " ।
No comments:
Post a Comment