বাংলা ভাষার সমস্ত লেখক - এক জায়গায় ক্রমানুসারে
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
জন্ম - ১০ই মে, ১৮৬৩ মৃত্যু - ২০শে ডিসেম্বর, ১৯১৫
ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ গিরিডি, ভারত
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
জন্ম - ১০ই মে, ১৮৬৩ মৃত্যু - ২০শে ডিসেম্বর, ১৯১৫
ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ গিরিডি, ভারত
" বিজন বনে কুসুম কত বিফলে বাস বিলায়ে যায় ,
নীরবে আহা ঝরিয়া পড়ে কেহ ত ক্ষতি মানে না তায় ।
তবু ত প্রভু তাহারো তরে করুণা ধারা তোমার বয় ,
বরষা বারি ধরায় ঝরে , উথলে আলো ভুবনময় ।
মায়ের কোলে পালিছ মোরে অমৃতধারে করায়ে স্নান ,
বরণ রস লহরী মাঝে পুলকে মম মজায়ে প্রাণ ।
ফুটায়ে যদি ফুলের মত তুলিছ এত যতনে নাথ ,
ফুলেরি মত চরণতলে রাখিয়ো মোরে দিবস রাত ।।"
উপরোক্ত লাইনগুলি বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী রচিত "প্রার্থনা" নামক কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন শিশুসাহিত্যিক, কবি, গল্পকার, চিত্রকর, বেহালাবাদক, সঙ্গীতানুরাগী ও বাংলা মুদ্রণ শিল্পের অগ্রপথিক। 1863 সালের ১০ই মে অবিভক্ত ভারতবর্ষের (বর্তমানে বাংলাদেশ) ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে এই দেশবরেণ্য লেখকের আবির্ভাব হয় । এই লেখকের পিতৃদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন রায় । কামদারঞ্জনের পিতার নাম শ্যামসুন্দর মুন্সী (তার প্রকৃত নাম কালীনাথ রায়, ইনি আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন বলে নিজেকে "শ্যামসুন্দর মুন্সী" নামে পরিচয় দিতেন)। এই পরিবারের নিকট আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায় চৌধুরীর কোন সন্তান ছিল না বলে তিনি শ্যামসুন্দরের রূপবান এই সন্তানকে দত্তক হিসাবে গ্রহন করেন এবং নতুন নামকরন করেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। পালকপিতা হরিকিশোর রায় চৌধুরী পৃষ্ঠপোষকতায় এই গল্পকার শিক্ষাজীবন আরম্ত করেন এবং 1880 সালে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার পর তিনি কলকাতায় আসেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে কিছুদিন বিদ্যাশিক্ষা করার পর তিনি কলকাতারই মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং 1884 সালে এখান থেকেই বি. এ. পাস করেন। স্কুলজীবনে এই লেখক চিত্রাঙ্কন এবং কলেজজীবনে ফোটোগ্রাফি শেখেন। এই সময়ে উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্মধর্ম গ্রহন করেন এবং বিশিষ্ট সমাজসেবী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা বিধুমুখীর সঙ্গে পরিণয়সুত্রে আবদ্ধ হন। কিশোর বয়সেই এই স্বনামধন্য লেখকের সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি হয় এবং সেইসময় যে সকল পত্রিকা (সখা, সাথী, মুকুল, বালক প্রভৃতি) প্রকাশিত হতো, তিনি প্রায় সব পত্রিকাতেই লিখতেন। তার প্রথম রচনা 1883 সালে "সখা" নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই মহান লেখক ছড়া, কবিতা, গান, গল্পমালা, রূপকথা, উপকথা, বিবিধ প্রবন্ধ, পৌরানিক গ্রন্থ এবং শিশু ও কিশোরদের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন । তার রচিত ছড়া ও কবিতাগুলির মধ্যে - খুকুমণি, শিশুর জাগরন, শিশুর কথা, সুখের চাকুরী, প্রার্থনা, চাঁদের বিপদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । তার গান রচনার মধ্যে - পাখির গান, রেলগাড়ির গান, গ্রীষ্মের গান ও ব্রহ্মসঙ্গীত উল্লেখযোগ্য। এই প্রথিতযশা লেখকের পৌরানিক গ্রন্থগুলির মধ্যে - ছেলেদের রামায়ন (1896), ছেলেদের মহাভারত (1908), মহাভারতের গল্প (1909), ছোট রামায়ন (1911) এবং পুরাণের গল্প (1919) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আর গল্পমালার মধ্যে - বানর রাজপুত্র, ঠানদিদির বিক্রম, কাজির বিচার, সাতমার পালোয়ান, দুঃখীরাম, গুপি গাইন ও বাঘা বাইন বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। এই লেখকের রচিত বিবিধ প্রবন্ধগুলির মধ্যে - তিনটি পর্বে বেলুন, দুটি পর্বে দাসত্বপ্রথা , তিনটি পর্বে পুরাতন কথা, হাফটোন ছবি, ফটোগ্রাফির চর্চা, হারমোনিয়াম শিক্ষা, দূরবীণ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সাহিত্যিক শিশু ও কিশোরদের কথা চিন্তা করে উপযুক্ত সাহিত্য রচনা করেছেন। 1903 সালে কিশোরদের জন্য "সেকালের কথা" নামক গ্রন্থ এবং শিশুদের জন্য 1910 সালে সাতাশটি ছোট গল্প একত্র করে "টুনটুনির বই" নামক গ্রন্থ রচনা করেন । এই কিংবদন্তী সাহিত্যিকের রচিত প্রথম বই "ছেলেদের রামায়ন"- যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হওয়া মাত্রই পাঠকসমাজে অতি আদরণীয়ভাবে সমাদৃত হয়। "ছেলেদের রামায়ন" ও "টুনটুনির বই" - নামক দুইটি গ্রন্থ জীবদ্দশাতেই লেখককে জনপ্রিয় করে তোলে। কিন্তু "ছেলেদের রামায়ন" গ্রন্থটির মুদ্রণ লেখকের পছন্দ না হওয়ায় তিনি 1895 সালে ইংল্যান্ড থেকে মুদ্রণযন্ত্রাংশ আমদানি করে মুদ্রণশালা খোলেন এবং তার নামকরন করেন ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। নিজের মুদ্রণশালা ছিল বলে তিনি হাফটোন ছবি ছাপার উন্নত পদ্ধতি আবিস্কার করেন এবং 1913 সালে "সন্দেশ" নামক এক যুগান্তকারী শিশুপত্রিকা প্রকাশ করেন । নিজেই এই পত্রিকার সম্পাদক, চিত্রকর, লেখক, প্রকাশক ও মুদ্রক ছিলেন। এই জনপ্রিয় লেখক সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীত সমন্ধে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি হারমোনিয়াম, বেহালা, সেতার, বাঁশি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাদনে দক্ষ ছিলেন এবং বেহালা তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ছিল। 1915 সালের ডিসেম্বর মাসের 20 তারিখে বিহারের গিরিডিতে এই খ্যাতনামা সাহিত্যিকের তিরোধান হয়।
No comments:
Post a Comment