বাংলা ভাষার সমস্ত লেখক - এক জায়গায় ক্রমানুসারে
সুবোধ কুমার চক্রবর্তী
জন্ম - ১৫ই মার্চ, ১৯১৮ মৃত্যু - ১৮ই জানুয়ারী, ১৯৯২
কোচবিহার, প.বঙ্গ, ভারত কলকাতা, ভারত
সুবোধ কুমার চক্রবর্তী
কোচবিহার, প.বঙ্গ, ভারত কলকাতা, ভারত
১৯১৮ সালের ১৫ মার্চ কোচবিহারের কাটামারি জমিদার পরিবারের সুশীলকুমার চক্রবর্তীর দ্বিতীয় পুত্র-সন্তান সুবোধকুমার চক্রবর্তীর জন্ম। কোচবিহার রাজপরিবারের সঙ্গে এই জমিদার পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল এবং রাজ্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন সুশীলকুমার। জেনকিন্স স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষে ১৯৩৮ সালে বিবাহের পর সুবোধকুমার কলকাতায় উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। তৎকালীন ইলাহাবাদে (বর্তমানে প্রয়াগরাজ) জওহরলাল নেহরুর লিয়াজঁ অফিসার হিসেবে কিছুদিন কাজ করে যোগ দেন রেলওয়ে বোর্ডে। টুম্বলাতেও ছিলেন বেশ কিছুদিন। অবশেষে পাকাপাকি ভাবে ইস্টার্ন রেলে কাজ নিয়ে আসানসোলে আসেন। জি টি রোড এবং ইয়েল রোডের সংযোগস্থলের বাংলোয় বসেই শুরু হয় তাঁর সাহিত্যচর্চা। এই বাংলোয় বনফুল-সহ বহু বিখ্যাত সাহিত্যিকেরা এসেছেন। পারিবারিক আত্মীয়তা থাকলেও লেখার সূত্রেই উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছিল। রেলের কাজেই তাঁকে ১৯৫৩-’৫৪ সালে দক্ষিণ ভারত যেতে হয়। আর সেখানকার অভিজ্ঞতা থেকেই লিখে ফেলেন ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’-এর প্রথম পর্বটি। তাঁর ইচ্ছে ছিল মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’-এর চিরস্মরণীয় শ্লোক ‘রম্যাণি বীক্ষ্যে মধুশ্চারং নিশম্য শব্দান’ থেকে শব্দবন্ধ ব্যবহার করে পরবর্তী ভ্রমণ কাহিনির নামকরণ করবেন। কিন্তু নিজেও ভাবেননি যে, বছরে দু’বার করে তাঁকে ভারতভ্রমণে বেরোতে হবে আর তিনি অনায়াসে লিখে ফেলবেন এতগুলি অবিস্মরণীয় পর্ব!
সজনীকান্ত দাশের পরামর্শেই ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’ নামটি এক রেখে পর্বগুলির আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয়। যেমন, কালিন্দী পর্ব, মগধ পর্ব, কামরূপ পর্ব ইত্যাদি। চাকরি-জীবনের শেষে কলকাতার সল্টলেকে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করেন সুবোধকুমার। এর পর জন্মভূমি কোচবিহারে বার কয়েক এলেও বেশি দিন থাকেননি। সল্টলেকেই ১৯৯২ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি প্রয়াত হন।
বাংলায় সার্থক ভ্রমণ সাহিত্য সে ভাবে পাওয়া যায় না। প্রবোধকুমার সান্যাল, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শঙ্কু মহারাজের মতো হাতে-গোনা কিছু কিংবদন্তির নাম বাদে সাহিত্যের এই ধারায় সে ভাবে লেখালিখি হয়নি। সুবোধকুমার চক্রবর্তীর সব চেয়ে বড় সাফল্য এখানেই যে, ভ্রমণ সাহিত্যের যে ধারা তিনি প্রবর্তন করেন, তা ছিল একেবারেই আলাদা। ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’-এর প্রতিটি পর্বে গোপাল ও স্বাতীর সম্পর্কের সূক্ষ্ম রসায়ন অন্য মাত্রা দিয়েছে পর্বগুলিকে। তাদের চোখ দিয়ে পাঠকের ভারতদর্শন হয়!
কিন্তু সুবোধকুমার চক্রবর্তী কখনওই গাইডের কাজ করেননি, দার্শনিকের কাজ করেছেন। পূর্ব জার্মানিতে তৈরি তাঁর নিজের রিফ্লেক্স ক্যামেরায় পছন্দের ছবি তুলেছেন, সেগুলি বিভিন্ন পর্বে রেখেছেন। কিন্তু হোটেলের নাম, খরচ, কোনও দ্রষ্টব্য স্থানে প্রবেশের মূল্য ইত্যাদির বর্ণনা করেননি। পর্যটকের দৃষ্টিতে সব দেখতেন বলেই তাঁর বর্ণনায় উল্লিখিত জায়গার ইতিহাস এবং তৎকালীন অবস্থা এমন ভাবে বিবৃত হয়েছে, যা পরবর্তীকালের গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর লেখার সাবলীল সহজ ভঙ্গী, বাছাই করা শব্দচয়ন, চিত্রকল্পের জাদুনির্মাণ প্রভৃতি। সবকিছু মিলে ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’ এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে যে, যা সাধারণ ভ্রমণ কাহিনির চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক। তাই এত সংখ্যক রচনা থাকা সত্ত্বেও তাঁর প্রধান পরিচয় ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’ গ্রন্থের লেখক হিসেবেই।
কালিন্দী পর্বে সুবোধকুমার ঋণ স্বীকার করেছেন জেনকিন্স স্কুলে তাঁর শিক্ষক উষাকুমার দাসের কাছে— ‘মাস্টারমশাই, হাতের লেখার সঙ্গে সঙ্গে গল্প লেখাও শিখিয়েছিলেন। এই সত্যটুকু প্রকাশ করে দিয়ে আজ আনন্দ পাচ্ছি’।
জন্ম শতবর্ষ অতিক্রান্ত সাহিত্যিক সুবোধকুমার চক্রবর্তীর জীবন ও সৃষ্টি নতুন প্রজন্মের কাছে একেবারেই অজানা। তাঁকে গভীর ভাবে পাঠ করলে বোঝা যায়, কী ভাবে সংসারে থেকেও একজন মানুষ পথিক হয়ে উঠতে পারেন! আসলে, পথিক হতে গেলে অন্য মন লাগে! সুবোধকুমারের সে মন ছিল বলেই সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন অনন্য ধারার সাহিত্য।
কোচবিহারের এক ভূমিপুত্রের সৌজন্যে বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্য নতুন দিশা পেয়েছিল। ‘টুরিস্ট’ ও ‘ট্রাভেলার’-এর মধ্যে পার্থক্য কী, তা বোঝা যায় তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’ গ্রন্থের ২৪টি পর্ব থেকে। তিনি সাহিত্যিক সুবোধকুমার চক্রবর্তী। অথচ, বাঙালি বোধ হয় তাঁকে ভুলতে বসেছে!
তাঁর এই গ্রন্থের পর্বগুলি পড়লে সমগ্র ভারত ভ্রমণ হয়ে যায়! অথচ, ১৯৫৪ সালে কলকাতায় ‘শনিবারের চিঠি’র দফতরে যখন সুবোধকুমার প্রথম পর্বের পাণ্ডুলিপিটি তুলে দিয়েছিলেন সম্পাদক সজনীকান্ত দাশের হাতে, তখনও যথেষ্ট দ্বিধায় ছিলেন যে, এ জাতীয় ভ্রমণ-কাহিনি আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে কি না। সজনীকান্ত পাকা জহুরির মতোই বেছে নিয়েছিলেন অমূল্য সেই রত্ন। তাই আসানসোলে ফেরার পরদিনই সজনীকান্ত দাসের চিঠি এসে পৌঁছেছিল এ কথা জানিয়ে যে, ‘শনিবারের চিঠি’তে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে চলেছে তাঁর সৃষ্টি। ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’-এর সেই দাক্ষিণাত্য পর্ব প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্য জগতে। এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’ যে, ১৯৫৫ সালে বই আকারে প্রকাশের সময় সজনীকান্ত তাঁর নিজের প্রকাশনা রঞ্জন পাবলিশার্স থেকে ১১০০ কপি ছেপেছিলেন। অতি দ্রুত শেষ হয়ে যায় প্রথম সংস্করণ। দ্বিতীয় সংস্করণে ২২০০ কপি ছাপা হয়। বিক্রি হয়ে যায় সব কপি। সজনীকান্তের প্রেরণাতেই এর পর সুবোধকুমার চক্রবর্তী লিখতে থাকেন ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’-এর নানা পর্ব। বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয় এক নতুন ধারা।
কিন্তু জন্ম শতবার্ষিকীতে সুবোধকুমার চক্রবর্তী যেন ব্রাত্যই থেকে গেলেন! পাঠকসমাজও যেন ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’কে ভুলতে বসেছে! ‘রম্যাণি বীক্ষ্য'-সহ সুবোধকুমার চক্রবর্তীর অন্যান্য নানা বই আজ আর মুদ্রিত হয় না। অথচ, আজ পঞ্চাশের কোঠায় বাংলা সাহিত্যের যে সব পাঠক, তাঁরা তাঁর ‘শাশ্বত ভারত’ সিরিজের ‘দেবতার কথা’, ‘অসুরের কথা’ ইত্যাদি পড়েই বড় হয়েছেন। মনে পড়ছে শীতকালে রোদে পিঠ দিয়ে মা পড়ছেন তাঁর উপন্যাস ‘জনম জনম’ বা ‘চোখের আলোয় দেখেছিলাম’। তাঁর ভ্রমণ-উপন্যাস ‘মণিপদ্ম’, ‘তুঙ্গভদ্রা’, ছোট গল্প ‘অয়ি অবন্ধনে’, ‘গল্প শুধু গল্প’, ভ্রমণের গল্প ‘সুন্দর নেহারি’ ইত্যাদি বহু গ্রন্থ পাঠকের নয়নের মণি ছিল সে আমলে।
No comments:
Post a Comment